চট্টগ্রাম বিভাগের রয়েছে শতাব্দী প্রাচীণ ইতিহাস । এ বিভাগের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য পুরাকীর্তি । নিম্নে জেলা ভিত্তিক পুরাকীর্তির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হল।
চট্টগ্রাম জেলা :
আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ, বাংলাদেশের চট্টগ্রামে অবস্থিত একটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য। চট্টগ্রামের চাটগছার আন্দরকিল্লার সাথে মোঘলদের চট্টগ্রাম বিজয়ের কাহিনী সম্পর্কিত। এই কিল্লা বা কেল্লায় মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের আস্তানা ছিলো। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে জানুয়ারি শায়েস্তা খাঁ'র ছেলে উমেদ খাঁ এই আন্দরকিল্লার অন্দরে বা ভিতরে প্রবেশ করলে এর নাম হয়ে যায় "আন্দরকিল্লা"। চট্টগ্রাম বিজয়ের স্মৃতি ধরে রাখতে সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে শায়েস্তা খাঁ ১৬৬৭ খ্রিস্টাব্দে এখানে নির্মাণ করেন "আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ"। ১৭২৩ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের আরেক শাসনকর্তা নবাব ইয়াসিন খাঁ, এই জামে মসজিদটির কাছাকাছি, পাহাড়ের দক্ষিণ-পূর্ব দিকের একটি টিলার উপর আরেকটি পাকা মসজিদ নির্মাণ করে তাতে "কদম-রসূল" রাখলে সাধারণ্যের কাছে ঐ মসজিদটি গুরুত্ব পেয়ে যায় এবং আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ লোকশূণ্য হয়ে পড়ে। ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে তাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী, এই মসজিদটিকে গোলাবারুদ রাখার গুদাম হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ঐতিহাসিক হামিদুল্লাহ খাঁ'র আবেদনের প্রেক্ষিতে মসজিদটি মুসলমানদের জন্য আবারও উন্মুক্ত হয়।
১৬৬৭ সালে এই মসজিদ নির্মাণের পর থেকেই চট্টগ্রামের ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান হয়ে উঠে আন্দরকিল্লার এই মসজিদ। এই মসজিদের ইমাম/খতিব নিযুক্ত হতেন পবিত্র মদিনার আওলাদে রাসুল (রাঃ) গন। ফলে অল্পদিনের মধ্যেই এই মসজিদ জনপ্রিয় হয়ে পরে। বলা বাহুল্য যে, এই জুমা মসজিদে প্রতি জুম্মায় চট্টগ্রাম ও এর আশেপাশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও মুসল্লিরা এসে নামায আদায় করতেন এবং পবিত্র মাহে রমজানের শেষ জুমায় কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকেও মানুষের সমাগমের নজির আছে। রোজা, ফিতরা এবং ঈদের চাঁদ দেখা প্রশ্নে এই মসজিদের ফয়সালা চট্টগ্রামের সর্বস্তরের জনগণ মেনে চলত অবধারিতভাবে। আন্দরকিল্লা জামে মসজিদের স্থাপত্য ও গঠন মোঘল রীতি অনুযায়ী তৈরি। সমতল ভুমি থেকে প্রায় ত্রিশ ফুট উপরে ছোট্ট পাহারের উপর এর অবস্থান। মূল মসজিদের নকশা অনুযায়ী এটি ১৮ গজ (১৬ মিটার) দীর্ঘ, ৭.৫ গজ (৬.৯ মিটার) প্রস্থ এবং প্রতিটি দেয়াল প্রায় ২.৫ গজ (২.২ মিটার) পুরু। পশ্চিমের দেয়াল পোড়া মাটির তৈরি এবং বাকি তিনটি দেয়াল পাথরের তৈরি। মধ্যস্থলে একটি বড় গম্বুজ এবং দুটি ছোট গম্বুজ দ্বারা ছাদ আবৃত। ১৬৬৬ সালে নির্মিত এর চারটি অষ্টভূজাকৃতির বুরুজগুলির মধ্যে এর পেছনদিকের দুটি এখন বিদ্যমান। মসজিদটির পূর্বে তিনটি ও উত্তর এবং দক্ষিণে একটি করে মোট ৫টি প্রবেশদ্বার রয়েছে। মসজিদটিতে তিনটি মেহরাব থাকলেও সাধারণত মাঝের ও সর্ববৃহৎ মেহরাবটিই ব্যবহৃরিত হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, মসজিদটি নির্মাণ কৌশলগত দিক থেকে দিল্লির ঐতিহাসিক জামে মসজিদের প্রায় প্রতিচ্ছবি হওয়ায় এটি চট্টগ্রাম অঞ্চলের মুসলিম স্থাপত্য বিকাশের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রার জন্ম দেয়। এই মসজিদটি দিল্লি জামে মসজিদের আদলে বড় বড় পাথর ব্যবহার করে নির্মিত বলে এই মসজিদকে পাথরের মসজিদ-"জামে সঙ্গীন"ও বলা হয়ে থাকে। শুধু স্থাপত্য নিদর্শনেই নয় শৈল্পিক দিক থেকেও এই মসজিদ উল্লেখ্য। কারন চট্টগ্রামে মুসলিম বিজয়ের স্মারকস্বরূপ হিশাবে শিলালিপি ভিত্তিক জেসব স্থাপনা আছে, সেইগুলোর মাঝে আন্দরকিল্লা জামে মসজিদের গায়ের শিলালিপি অন্যতম। মসজিদের মূল ইমারতের প্রবেশপথে কালো পাথরের গায়ে খোদাইকৃত সাদা অক্ষরে লেখা ফার্সি লিপির বঙ্গানুবাদ জা দাঁড়ায় তা হলঃ "হে জ্ঞানী, তুমি জগতবাসীকে বলে দাও, আজ এ দুনিয়ায় ২য় কাবা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যার প্রতিষ্ঠাকাল ১০৭৮ হিজরি(১৭৬৬ সাল)। " এই শিলালিপি থেকে এর প্রতিষ্ঠাতার নামও পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে বলা যায় যে, এই মসজিদে পাওয়া সকল শিলালিপির সাথে সিরিয়ার "রাক্কা নগর"-এর স্থাপত্যকলার মিল পাওয়া যায়।
চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারচট্টগ্রামেরনন্দনকাননেঅবস্থিত। বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতি১৮৮৯খ্রিস্টাব্দে এই বিহার প্রতিষ্ঠা করে। এই বিহার বাংলাদেশের বৌদ্ধদের অন্যতম পূণ্যস্থান হিসাবে বিবেচিত হয়। শতাব্দী পুরাতন বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতির (তৎকালীন চট্টগ্রাম বৌদ্ধ সমিতি) প্রথম সভাপতি শ্রীমৎউ. গুনামেজু মহাথের এবং সাধারণ সম্পাদক নাজিরকৃষ্ণ চৌধুরী বিহার স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। প্রাথমিকভাবে ভক্ত এবং পূজারীদের আর্থিক সহযোগিতায় ভবনটির একতলা নির্মিত হয়। ১৯০৩সালে চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লাস্থ রংমহলপাহাড়ে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালনির্মাণের জন্য মাটি খননকালে একটা পুরাতন বৌদ্ধ মূর্তি পাওয়া যায়। বিহারেরসে সময়ের অধ্যক্ষ অগ্ গমহা পন্ডিত-উ-ধম্মবংশ মহাথের এর তৎপরতার কারণে মূর্তিটি বঙ্গীয় সরকার এ বিহারে প্রদান করে। বিহারের মূল ভবনটির পাশেই অপর একটি মন্দিরে মূর্তিটি স্থাপন করা হয়। এটি “বুড়াগোঁসাই মন্দির” নামে পরিচিত।
১৮৮৯সালে প্রতিষ্ঠার পর এই বিহারের প্রথম অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন অগ্ গমহা পন্ডিত-উ-ধম্মবংশ মহাথের, দ্বিতীয় অধ্যক্ষ শ্রীমৎদীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান মহাথের, তৃতীয় অধ্যক্ষ অধ্যাপক শীলাচার শাস্ত্রী, চতুর্থ অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন শ্রীমৎসুবোধিরত্ন মহাথের, পঞ্চম অধ্যক্ষ শ্রীমৎজ্যোতিঃপাল মহাথের এবং ষষ্ঠ অধ্যক্ষ আছেন শ্রীমৎজ্ঞানশ্রী মহাস্থবির। ২০০৫সালে বিহারে প্রবেশের দুই পাশে অধ্যক্ষ শ্রীমৎদীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান মহাথের এবং অধ্যক্ষ অধ্যাপক শীলাচার শাস্ত্রী মহাস্থবিরের স্মৃতিমন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়। এছাড়াও বিহারের মূল ভবনের দ্বিতীয় তলায় গৌতম বুদ্ধেরআসনের নিচে দুইপাশে পন্ডিত-উ-ধম্মবংশ মহাথের এবং শ্রীমৎদীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান মহাথের এর আবক্ষ মূর্তি প্রতিষ্ঠিত আছে।
বিহারের মূল ভবনের দ্বিতীয় তলায় গৌতম বুদ্ধের মূর্তি।
গৌতম বুদ্ধের কেশধাতু
ত্রিশের দশকে আচার্য শাক্য নামে তিব্বতের এক সন্ন্যাসী চট্টগ্রাম ভ্রমণে আসেন। তিনি তখন কিছুদিনের জন্য বৌদ্ধ বিহারে অবস্থান করেন এবং বিহারের অধ্যক্ষ অগ্ গমহা পন্ডিত-উ-ধম্মবংশ মহাথেরকে বুদ্ধের কেশধাতু প্রদান করেন। অতি দুর্লভ এই কেশধাতুর কিছু অংশ ১৯৫৮ সালে শ্রীলংকায়, ১৯৬৪ সালে জাপানে, ১৯৭৯ সালে থাইল্যান্ডে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রদান করা হয়। শ্রীলংকার সরকার ২০০৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে বৌদ্ধ সমিতি হতে আবারো কেশধাতু গ্রহণ করে।
বিহার প্রাঙ্গণের বোধিবৃক্ষ
থাইল্যান্ড থেকে আনা গৌতম বুদ্ধেরদুই প্রধান শিষ্য অগ্রশ্রাবক ধর্মসেনাপতি “সারিপুত্র” এবং ঋষিশ্রেষ্ঠ “মহামোগলায়ন” মহাস্থবিরদ্বয়ের অষ্টধাতুর নির্মিত মূর্তি বুড়াগোঁসাই মন্দিরে স্থাপন করা হয়।
শ্রীলংকার সরকারপ্রদত্ত গৌতম বুদ্ধেরস্মৃতিধন্য বোধিবৃক্ষেরএকটি চারা ১৯৮০সালের ১৫ নভেম্বরচট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারেরোপণ করা হয়। ১৯৯১সালে বোধিবৃক্ষেরনিচে বোধিমন্ডপ নির্মাণ করা হয়।
চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারে বিভিন্ন দূর্লভ পাণ্ডুলিপিসমৃদ্ধ একটি গ্রন্থাগার আছে। এটির নাম চিন্তামনি গ্রন্থাগার। এখানে তালপাতার পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে। এই সংগ্রহশালায় আছে পালি ভাষা, বর্মী ভাষা, সংস্কৃত ভাষায়রচিত প্রাচীন ধর্মীয় শাস্ত্র। শাস্ত্রীয় সাহিত্য এবং তালপাতায় রচিত শিল্পকর্ম এই গ্রন্থাগারকে সমৃদ্ধ করেছে।বৌদ্ধ বিহারে এছাড়াও আছে বুড্ডিষ্ট হোস্টেল, ধম্মবংশ ইন্সটিটিউট, চিকিৎসা কেন্দ্র ইত্যাদি।
চট্টেশ্বরীমন্দির
শ্রী শ্রী চট্টেশ্বরী কালী মায়ের বিগ্রহ মন্দিরবাংলাদেশের বিখ্যাত হিন্দু মন্দিরসমূহের মধ্যে অন্যতম। জনশ্রুতি মতে, প্রায় ৩০০-৩৫০ বছর পূর্বে আর্য ঋষি যোগী ও সাধু সন্ন্যাসীদের মাধ্যমে শ্রী শ্রী চট্টেশ্বরী দেবীর প্রকাশ ঘটে। এটি বাংলাদেশের বন্দর নগরী চট্টগ্রামের চট্টেশ্বরী সড়কে তিন পাহাড়ের কোনে অবস্থিত।মূল রাস্তা থেকে একটু উঁচুতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে মধ্যের বাঁধানো চত্বরটির বাঁদিকে কালী মন্দির ও ডানদিকে শিব মন্দির। শিব মন্দিরের পাশে রয়েছে একটি কুন্ড।বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেরসময় পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের দ্বারা এই মন্দিরটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবঙ মন্দিরের সেবায়েতের বাড়ী ও বিগ্রহ বিনষ্ট করা হয়। দেশ স্বাধীনতা লাভের পর মন্দিরের সেবায়েত ডাঃ তারাপদ অধিকারী তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের বাণিজ্য মন্ত্রী তরুণ কান্তি ঘোষ এবং সনাতন ধর্মীদের সাহায্য ও সহযোগিতায় কষ্টি পাথরের কালী মূর্তি ও শ্বেত পাথরের শিব মূর্তি পুনঃনির্মান করেন, যাতে ও বাংলাদেশ সরকারও প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করে।
কদমমোবারকমসজিদ, কদমমোবারক, চট্টগ্রাম
মোগল-আমলের অনুপম পুরাকীর্তি মোমিন সড়কের কদম মোবারক মসজিদ। এ মসজিদটি চসিক-এর অধীন জামালখান ওয়ার্ডে অবস্থিত। এই মসজিদ সংলগ্ন এলাকাটিও 'কদম মোবারক' নামে পরিচিত। কদম মোবারক নামটি এসেছে দুটি পাথরের পবিত্র পদচিহ্ন থেকে। এ মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণ পাশে দুটি ছোট কামরা আছে। উত্তর দিকের কামরায় হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর ডান পায়ের ছাপ বিশিষ্ট প্রস্তরখণ্ড সংরক্ষিত আছে। এর পাশে রয়েছে বড়পীর হজরত আবদুল কাদের জিলানি (র.)-এর পদচিহ্ন। কথিত আছে, মসজিদের প্রথম মুতওলি ইয়াছিন মুহাম্মদ খান পবিত্র মদিনা শরিফ থেকে মহানবী (স.)-এর কদমের ছাপ সংগ্রহ করেছিলেন। উত্তর দক্ষিণে বিস্তৃত আয়তাকার মসজিদটি পাঁচ গম্বুজের। একটি বড় গম্বুজ আর দুপাশে দুটি ছোট গম্বুজ য।র উত্তর ও দক্ষিণে চারকোনা আরও দুটি গম্বুজ রয়েছে। সামনের দেয়ালের মাঝের দরজার দুপাশে আছে খিলান দেওয়া তিনটি দরজা। দরজা-সোজা ভেতরে পশ্চিম দেয়ালে আছে তিনটি মেহরাব। স্থাপত্যের ক্ষেত্রে মোগলেরা খিলান গম্বুজ ও খিলান ছাদকে প্রাধান্য দিত। লতাগুল্মের নকশা, আরবি ক্যালিওগ্রাফি, জ্যামিতিক রেখাচিত্র, মোজাইক নকশা বসানো পাথরের সাজে সজ্জিত মসজিদটি। বিভিন্ন সময়ে সংস্কার ও সম্প্রসারণের পরও সর্বত্র প্রাচীনতা ও মোগল স্থাপত্যের সৌন্দর্য এতটুকু কমেনি। এ মসজিদকে কেন্দ্র করে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী প্রতিষ্ঠা করেন কদম মোবারক মুসলিম এতিমখানা। এটিই চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় এতিমখানা। গড়ে উঠেছে কদম মোবারক উচ্চবিদ্যালয় ও ইসলামাবাদী স্মৃতি মিলনায়তন। মুতওলি আজাদ উল্লাহ খান বলেন, ‘মসজিদ-দরগাসংলগ্ন প্রশস্ত আঙিনায় একটি ইসলামি গবেষণাকেন্দ্র, চিকিৎসাকেন্দ্র ও কবরস্থান গড়ে তোলার প্রক্রিয়া চলছে। এ ছাড়া একটি আধুনিক ইসলামি কমপ্লেক্স গড়ে তোলার পরিকল্পনাও আছে।’
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের সবচেয়ে প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন ঐতিহাসিক ছুটি খাঁ জামে মসজিদ। ঢাকা-চট্টগ্রাম পুরনো মহাসড়কের পশ্চিম পাশে উপজেলার জোরারগঞ্জ বাজারের আধাকিলোমিটার উত্তরে ছুটি খাঁ দীঘির পূর্ব পাড়ে এ মসজিদের অবস্থান।এ মসজিদের ইতিহাস সম্বন্ধে জানা যায়, গৌড়ের সুলতান হোসেন শাহের আমলে পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে উত্তর চট্টগ্রামের শাসনকর্তা ছিলেন লস্কর পরাগল খাঁ ও পরবর্তীতে তার ছেলে ছুটি খাঁ। পরাগল খাঁর পিতা রাস্তি খাঁ ও গৌড়ের শাসনকর্তা রুকুনুদ্দীন বারবাক শাহের শাসনামলে চট্টগ্রামের শাসনকর্তা ছিলেন। পরাগল খাঁ ও ছুটি খাঁ'র শাসনামলে চট্টগ্রামের শাসন কেন্দ্র ছিল পরাগলপুর। এ সময় এখানে বেশ কিছু দিঘি ও কয়েকটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ছুটি খাঁ মসজিদের মূল মসজিদটি বহুদিন আগে ভেঙে পড়েছে। পরবর্তীতে একটি মসজিদ নতুনভাবে নির্মিত হয়েছে। যেখানে মূল মসজিদের বেশকিছু ছোট-বড় পাথর ও শিলালিপি দেখতে পাওয়া যায়। পুরনো মসজিদের কিছু ধ্বংসাবশেষ প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শন হিসাবে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ সংরক্ষণ করেছে বলে জানা যায়। পাথরগুলো ভারতের রাজস্থান বা অন্যান্য প্রদেশ থেকে আনা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কৃষ্ণবর্ণের নানা ডিজাইন ও সাইজের পাথরগুলো মসজিদ প্রাঙ্গণে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এখনো। স্থানীয়রা জানান, ছুটি খাঁ দিঘির অভ্যন্তরে ও মসজিদের ভেতরে একাধিক শিলালিপি রয়েছে। তার মধ্যে একটি শিলালিপিতে পবিত্র কোরআন শরিফের আয়াতুলকুরসি লিখাআছে।সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ছুটি খাঁ মসজিদ লিপি খোদিত পাথরের ব্লক দিয়ে নির্মিত ছিল। সেগুলো ইতস্তত পড়ে আছে বর্তমান মসজিদের আঙিনায়। কিন্তু সবগুলোতেই দেখা গেছে তোগরা হরফে কোরআনের নানা আয়াত ও আরবি দোয়া। তবে ঐতিহাসিক মূল্যবিশিষ্ট কোনো লিপি পাওয়া যায়নি। ছুটি খাঁ কর্তৃক এ মসজিদ স্থাপন করা হয় ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দে।তবে মসজিদটির নির্মাতা পরাগল খাঁ নাকি ছুটি খাঁ, তার কোনো লিখিত সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই। নির্মাতা যেই হোন, এ মসজিদটি অদ্যাবধি পাঁচশ বছর ধরে এ অঞ্চলের কীর্তিমান শাসক, পার্শ্ববর্তী ত্রিপুরা ও আরাকানী অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াকু সৈনিক ছুটি খাঁ'র স্মৃতি হিসেবে টিকে আছে।
বদরআউলিয়ারদরগাহ
চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে প্রাচীন স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি নগরীর বকশির হাট এলাকায় বদরপাতি রোডে অবস্থিত। বদর পীরের নামানুসারে স্থাপনাটির নামকরণ করা হয়। চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচারক প্রথম সুফি সাধক হিসাবে বদর শাহই পরিচিত। চট্টগ্রামে তিনি বিভিন্ন নামে পরিচিত যেমন- বদর আলম, বদর মোকাম, বদর পীর, বদর শাহ, বদর আউলিয়া প্রভৃতি। তাঁর আগমন নিয়ে অনেক মজার মজার কথা প্রচলিত আছে। বদর পীরের চাটির কথা চট্টগ্রামে আজো কিংবদন্তি; কেউ কেউ মনে করেন, বদর শাহের চাটি থেকে চাটিগ্রাম হয়ে চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি।চট্টগ্রাম মুসলমানদের রাজ্যভূক্ত হওয়ার আগে অর্থ্যাৎফখরুদ্দিন মোবারক শাহ চট্টগ্রাম জয় করার আগেই ইসলাম প্রচারের জন্য সুদূর আরব থেকে হযরত বদর শাহ (রঃ) এখানে আসেন। বলা হয়, পাথরের বুকে চেপে সাগর পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রামে পৌঁছেন তিনি। চট্টগ্রামের মানব ব্রজিত পরিবেশে তিনি দৈত্যদানবের কাছ থেকে এবাদত করার জন্য এক চাটি পরিমাণ জায়গা চেয়ে নেন। চাটির আলো ও আজানের ধবনির বিস্তারে দৈত্য-দানবরা পালিয়ে যায়। এ ঐতিহ্যবাহী চাটি হতে চট্টগ্রামের নামকরণ বলে ব্যাপক জনশ্রতি আছে। আউলিয়া বদর শাহই প্রথম চট্টগ্রামে চেরাগ জেলে গোড়াপত্তন করেন এ শহরের। আর এই ঐতিহাসিক স্মৃতি বহন করছে মোমিন রোডস্থ 'চেরাগী পাহাড়'।অনেকে মনে করেন , ১৪৪০ সালে মৃত্যুমুখে পতিত হওয়া বিহারের ছোট দরগাহে শায়িত পীর বদর উদ্দীন বদর-ই-আলম আর বন্দর নগরীর বদরপাতি পীর একই ব্যক্তি। কিন্তু এর সাথে দিমত পোষণ করেন। বদরশাহ মানুষের গানের মধ্য দিয়েও বেঁচে আছেন, তার প্রমাণ- মাঝিদের বিখ্যাত উদ্দীপনামূলক গান-"বদর বদর বদর বদর হেঁইয়ো--বদর বদর বদর বদর হেঁইয়ো"। চট্টগ্রামে পীর বদরের আস্তানা প্রায় সাড়ে ছয়শো বছরের স্মৃতি বহন করছে। পীর বদরের সমাধি ভবনটি সুলতানি আমলে তৈরী করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
বখশীহামিদমসজিদ
চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী উপজেলার ইলশা গ্রামে একটি দীঘির পাড়ে নির্মিত প্রাচীন একটি মসজিদ। এই মসজিদটির নির্মাণ কৌশলের সাথে ঢাকার শায়েস্তা খান (আনুঃ ১৬৬৪ খৃঃ) মসজিদ এবং নারায়নগঞ্জের বিবি মরিয়ম মসজিদের (আনুঃ ১৬৮০ খৃঃ) মিল লক্ষ্য করা যায়। মিহরাবের উপর স্থাপিত আরবী শিলালিপির বক্তব্য মতে, এটি সুলাইমান কররানি কর্তৃক প্রতিষ্ঠা করার কথা থাকলেও লোকমুখে বখশী হামিদের নির্মিত মসজিদ বলে পরিচিত। বর্তমান এ মসজিদ এর পাশে একটী হেফজখানা রয়েছে।মসজিদ এবং হেফজখানার পরিচালনাই আছেন মাওলানা মুজিবুর রহমান।
কক্সবাজার জেলা :
প্রাচীন ঐতিহ্য:
১৬০০---১৭০০খৃষ্টাব্দেশাহসুজারআমলেএকটি মসজিদ তৈরী হয়েছিল। এটি চৌধুরী পাড়া মসজিদ বা আজগবি মসজিদ নামেপরিচিত। এটি কক্সবাজার সদরের বি.ডি.আরক্যাম্পেরউত্তরদিকেঅবস্থিত।
প্যাগোড়া (জাদী):
১৭৯০ ইংরেজী সালের দিকে বার্মিজরাআরাকান বিজয়ের পর কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় রাখাইন সম্প্রদায় এটি নির্মাণকরে। তারা এটিকে স্মৃতিচিহ্ন বলে। কক্সবাজার সদর, রামু ও টেকনাফের পাহাড়বা উচুঁ টিলায় এ ধরনের প্যাগোড়া দেখা যায়
অগ্গ মেধা বৌদ্ধ ক্যাং:
কক্সবাজার সদরে ছোট বড় মিলিয়ে৭টিরও বেশী বৌদ্ধ ক্যাং রয়েছে। আগ্গা মেধা ক্যাং ও মাহাসিংদোগীক্যাং সবচেয়েবড়। এ সবে স্থাপিত বৌদ্ধ মুর্তিগুলো দেখবার মতো। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদেরধর্মীয় উৎসব বৌদ্ধ পূর্ণিমা, প্রবারণা পূর্ণিমা ও বিষু উৎসব ক্যাং এ উদযাপনহয়।
রামকোট তীর্থধাম:
এটি রামকোট বনাশ্রমের পার্শ্বেরপাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। ৯০১ বাংলা সনে স্থাপিত। কথিত আছে রাম-সীতাবনবাসকালে এই রামকোটে অবস্থান করেছিল। তীর্থধামে মন্দিরের পাশাপাশি আলাদা একটিবৌদ্ধ বিহারে ধ্যানমগ্ন ছোট একটি বৌদ্ধমূর্তিও রয়েছে। জনশ্রুতি আছে, দু’টিধর্ম পাশাপাশি শান্তিতেসহাবস্থানের প্রমাণ স্বরূপ সম্রাট অশোকের সময়েএইমূর্তি স্থাপিত হয়
ছেংখাইব ক্যাং:
রামুর শ্রীকুলস্থ বাঁকখালী নদীর তীরেছেংখাইব ক্যাং (বৌদ্ধবিহারটি) অবস্থিত।এবৌদ্ধবিহারেনানারকমনক্সাখচিত আসন ও কাঁচের পাত্রে সংরক্ষিত ১০টিরও বেশী পিতল এবং আরো অনেক শ্বেতপাথরের মূর্তি শোভা পাচ্ছে। সব মিলে রামু থানায় ২৩টি বৌদ্ধ বিহারে শতাধিকমূল্যবান বৌদ্ধ মূর্তি রয়েছে।
কানা রাজার সুড়ংগ:
উখিয়া থানার জালিয়া পালং ইউনিয়নে পাটুয়ার টেক সৈকতের কাছে নিদানিয়া পাহাড়ের মধ্যে এ সুড়ংগ বা গর্ত। সুড়ংগেরব্যাস ১২ও ১২ একটা বড় ট্রাক অনায়াসে সুড়ংগ পথে প্রবেশকরতে পারবে। কথিত আছে, জনৈক মগ সম্প্রদায়ের কানা রাজার (একচোখঅন্ধ) শাসনআমলেআত্মরক্ষারজন্যেএই সুড়ংগ নির্মান করেছিল।
মাথিনেরকূপ:
উপন্যাসিক ধীরাজ ভট্টাচার্য উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে এস.আই. হিসাবেটেকনাফথানায়বদলীহয়েএসেছিলেন।তখনটেকনাফের নাম করা রাখাইন জমিদার ওয়াংথিনের একমাত্র আদুরে কন্য মাথিন থানার সামনের কুয়া থেকে নিয়মিত পানি নিতে আসতো। সকাল বিকাল পানি নিতে আসা ছিল মাথিনের সখ। পুলিশ কর্মকর্তা প্রতিদিন থানার বারান্দায় বসে বসে অপূর্ব সুন্দরী মাথিনের পানি নিতে আসা যাওয়া দেখতেন। আস্তে আস্তে ধীরাজভট্টাচার্যের সংগে মাথিনের চোখা চোখি এবং পরে তা’ প্রেমে পরিণত হয়।বিয়ে করতে ব্যর্থ হলে, মাথিন বিচ্ছেদের জ্বালায় তিলে তিলে দগ্ধ হয়ে মৃত্যু বরণকরে। মাথিনের অতৃপ্ত প্রেমের ইতিহাসের নীরব সাক্ষী মাথিনের কুপ। টেকনাফ থানা প্রাঙ্গনে একুপের অবস্থান। বিশিষ্ট সাংবাদিক আবদুল কুদ্দুস রানা ১৯৯৪ সালে বাঁশের তৈরী কূপটি সংস্কারের উদ্যোগ নেন। পরবর্তীতে জেলা পরিষদ থেকে এদিকে সংস্কার করা হয়। এখন কূপটি দেখতে খুবই আকর্ষনীয়। সেখানে প্রেমের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসও লেখা রয়েছে। ইদানীং উল্লিখিত কাহিনী অবলম্বনে স্থানীয় শিল্পীদের নিয়ে একটি স্বল্প দৈর্ঘ্য চলচিত্রও নির্মিত হয়েছে।
‘মা’ অষ্টভূজা:
মহেশখালী আদিনাথশিব মন্দিরের পার্শ্বে ‘অষ্টভূজা’ নামে অপর একটি বিগ্রের মূর্তি রয়েছে।কক্সবাজার কস্তুরাঘাট হতে নৌযানে ৪৫-৫৫ মিনিটআরস্পীডবোটে১৫-১৮মিনিটসময়লাগে।মহেশখালীর গোরকঘাটা জেটি হতে রিক্সা যোগে আদিনাথ মন্দির যাওয়া যায়।
কুমিল্লা জেলা :
শালবনবিহার
কুমিল্লা শহর থেকে ৯ কিমি. পশ্চিমে লালমাই ময়নামতি নামক অনুচ্চ গিরি শ্রেণীর পাদদেশে অবস্থিত। বর্গাকার এই বৌদ্ধ বিহারের প্রতি বাহুর পরিমাপ ১৬৭.৬৪ মিঃ। বিহারের ৪টি বাহুতে সর্বমোট ১১৫ টি ভিক্ষু কক্ষ ছাড়াও বিহারাঙ্গনে রয়েছে ক্রুশাকার কেন্দ্রিয় মন্দির। এটিকে শেষ নির্মাণ যুগে আয়তাকার মন্দিরে রুপান্তর করা হয়। মন্দিরের দেয়াল পোড়ামাটির ফলক চিত্র দ্বারা অলংকৃত ছিল। প্রত্মতাত্ত্বিক খননে এ প্রত্মকেন্দ্রে ৬টি নির্মাণ যুগের সন্ধান পাওয়া যায় এবং ১ম নির্মাণ যুগ ৬ষ্ঠ শতক এবং শেষ নির্মাণ যুগ ১২শ শতক বলে প্রত্মতাত্ত্বিকগন মনে করেন। বিহারের উত্তর বাহুর মধ্যবর্তী স্থানে বিহারের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য ১টি মাত্র প্রবেশ পথ এবং প্রবেশ পথের বাইরে উত্তর পশ্চিম পাশে আরও ১ টি ছোট আকারের মন্দির পরিলক্ষিত হয় যা বিহারের সমসাময়িক কালে নির্মিত বলে ধারণা করা হয়।
রুপবানমুড়া
কুমিল্লা শহর হতে ৮ কিমি. পশ্চিমে লালমাই-ময়নামতি পাহাড় শ্রেণীর মধ্যবর্তী এবং কুমিল্লা কালির বাজার সড়কের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঢিবিটি সম্প্রতিকালে প্রত্মতাত্ত্বিক খনন পরিচালনা করে ৩৪.১৪ মি. X ২৫ মি. পরিমাপের ১ টি বৌদ্ধ বিহার ও ২৮.৯৬ মি. X২৮.৯৬ মি. পরিমাপের ক্রুশাকার মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ উন্মোচন করা হয়েছে। মন্দিরের পূর্ব পার্শ্বস্থ প্রকৌষ্ঠ থেকে বেলে পাথরের অভয় মুদ্রায় দন্ডায়মান বৃহদাকার ১ টি বৌদ্ধ মূর্তি পাওয়া যায়। খননে প্রাপ্ত স্থাপত্য নিদর্শন ও প্রত্ম সম্পদ বিশ্লেষনে এই প্রত্মকেন্দ্রের সময়কাল পন্ডিতগন খ্রী. ৭ম থেকে ১২শ শতাব্দী বলে অনুমান করেন।
ইটাখোলামুড়া
রুপবান মুড়া প্রত্মকেন্দ্রের উত্তর পাশে অবস্থিত আরও ১ টি অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ প্রত্মকেন্দ্র স্থানীয়ভাবে ইটাখোলা মুড়া নামে পরিচিত। এই স্থানে সম্প্রতি খনন পরিচালনা করে ৩৯.৬২ মি. X৩৯.৬২ মি. পরিমাপের ১টি বৌদ্ধ বিহার, ৬০.৬৬ মি. X২৫ মি. পরিমাপের ১টি আয়তাকার মন্দির এবং বেশ কয়েকটি স্তুপের সন্ধান পাওয়া গেছে। উন্মোচিত মন্দিরটিতে মোট ৫টি নির্মাণ যুগের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়।
ভোজরাজারবাড়ী
এই প্রত্মকেন্দ্রটি কুমিল্লা শহর হতে ৮ কিমি. পশ্চিমে কোটবাড়ী-টিপরা বাজার ক্যান্টনমেন্ট সড়কের পশ্চিম পাশে অবস্থিত। স্থানীয়ভাবে এটি ভোজ রাজার বাড়ী নামে পরিচিত। সম্প্রতি খননের ফলে ১টি বৌদ্ধ বিহারের আংশিক কাঠামো আবিষ্কৃত হয়েছে। বিহারটি বাহ্যিক পরিমাপ ১৭৩.৪৩ মি. X১৭৩.৪৩ মি. এর দক্ষিণ বাহু সম্পুর্ণ খননের ফলে দু’প্রান্তে দুটি কক্ষ ছাড়াও ৩১ টি কক্ষ উন্মোচিত হয়েছে। ফলে সিড়ি কক্ষ ছাড়া বিহারে ১২৪ টি কক্ষ আছে বলে অনুমিত হয়। বিহারের উত্তর বাহুর মধ্যভাগে মুল ফটকটির আংশিক নিদর্শন উন্মোচিত হয়েছে এবং এর কেন্দ্রস্থলে প্রদক্ষিণ পথ সহ ১টি ক্রশাকার চর্তুমুখী মন্দির আবিষ্কৃত হয়েছে। ক্রুশাকার মন্দিরটির পরিমাপ ৪৬.৩৩ X৪৬.৩৩ মি.। এই প্রত্মস্থানে খননের ফলে কেন্দ্রীয় মন্দির হতে ১টি ব্রোঞ্জের বৃহদাকার বুদ্ধ মুর্তি, ২টি স্থানীয় নরম পাথরে তৈরী বুদ্ধ মূর্তি এবং ১টি রৌপ্য মুদ্রা উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া অনেকগুলো পোড়ামাটির ফলক পাওয়া গেছে। এ পর্যন্ত খননের ফলে মোট ৪টি নির্মাণ যুগের নিদর্শন পরিলক্ষিত হয়। আবিষ্কৃত স্থাপত্য কাঠামো এবং প্রত্মসম্পদের বিবেচনায় এ নিদর্শনটির সময়কাল ৮ম হতে ১২শ শতাব্দী নিরুপন করা যেতে পারে।
চাঁদপুর জেলা :
চাঁদপুর- এর কচুয়া, হাজীগঞ্জ উপজেলার কিছু অংশ ও শাহরাস্তি উপজেলার মেহের শ্রীপুর অঞ্চলটি সবচেয়ে প্রাচীন। বাংলার সুলতান ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ্ এর রাজত্বকালে (১৩৩৮-১৩৪৯) দেওয়ান ফিরুজ খান লস্কর এর খনন করা দীঘির পশ্চিম পাড়ে ৭৭৫ হিজরীতে একটি মসজিদ স্থাপন করা হয়। এ মসজিদই সম্ভবত বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার সর্ব প্রাচীন মসজিদ। এটি হাজীগঞ্জ উপজেলার সামান্য উত্তরে পিরোজপুর গ্রামে অবস্থিত। চাঁদপুর জেলার ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে হাজীগঞ্জ এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। হাজী মনিরুদ্দিন শাহ (মনাই গাজী) এর হাজী দোকান এর সুখ্যাতিতে গড়ে উঠা বাজার থেকে হাজীগঞ্জ শব্দের উৎপত্তি ঘটে। জেলার ধর্মীর প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যমত হাজীগঞ্জে অবস্থিত ঐতিহাসিক বড় মসজিদ স্থাপিত হয় ১৩০০ বঙ্গাব্দে (১৮৯৩ খ্রিঃ)। হাজীগঞ্জের ৬ মাইল পশ্চিমে অলিপুর গ্রাম। এ গ্রামে দুটি প্রাচীন মসজিদ আছে। একটি শাহ সুজার আমলে নির্মিত সুজা মসজিদ। অপরটি মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে নির্মিত আলমগীর মসজিদ নামে পরিচিত। এটি নির্মাণ করেছিলেন ১৩৭০ খ্রিঃ মোঃ আবদুল্লাহ। আলীগঞ্জের মাদা্হ খাঁ নামের এক দরবেশের নামে ১৭৩৮ খ্রিঃ স্থাপিত হয় বর্তমান মাদা্হ খাঁ মসজিদ।১৩৫১ সালে মেহের শ্রীপুর অঞ্চলে এসেছিলেন বিখ্যাত আউলিয়া হযরত রাস্তি শাহ। ১৩৮৮ খ্রিঃ তিনি ইন্তেকাল করেন। মেহের শ্রীপুর-এ তাঁর মাজার অবস্থিত। বিখ্যাত হিন্দু সাধক সর্বানন্দ ঠাকুর এ মেহেরেই দশ মহাবিদ্যা সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। সিদ্ধি লাভের স্থানটিতেই গড়ে উঠেছে মেহের কালবাড়ী। হযরত রাস্তি শাহ্ এর নামেই এ অঞ্চলের নাম হয় শাহ্রাস্তি। এটিই এখন শাহ্রাস্তি উপজেলা নামে পরিচিত।
চাঁদপুর শহরের ৬ মাইল পুর্বে শাহতলী গ্রামটি বাগদাদ থেকে আগত দরবেশ শাহ মোহাম্মদ সাহেবের নাম থেকে হয়েছে। তিনি সুলতান ফিরোজ শাহের রাজত্বকালে ধর্ম প্রচারের জন্য এ অঞ্চলে এসেছিলেন। তিনি সুলতানের নিকট থেকে নিস্কর জমি লাভ করেছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে চাঁদপুর মহকুমার প্রথম মঠ স্থাপিত হয়েছিল বাবুরহাটের কাছে বর্তমান মঠখোলায়। বাবুর হাট তখনও স্থাপিত হয়নি।নাসিরকোট গ্রামটি হাজীগঞ্জ উপজেলা সদর হতে প্রায় ১০ মাইল উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত। নবাব সিরাজ-উদ দৌলার সময় কচুয়া থানার আলীয়ারায় ক্ষত্রীয় রাজা অযোধ্যারাম ছেদ্দা নিজেকে স্বাধীন নরপতি হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা তাকে দমনের জন্য সেনাপতি নাসির খানকে প্রেরণ করেন। নাসির খান এখানে একটি দূর্গ নির্মাণ করেন। যুদ্ধে ছেদ্দা পরাজিত ও নিহত হন। কোট অর্থ দূর্গ। তাই নাসির খানের দূর্গের জন্যই এই গ্রামের নাম হয় নাসিরকোট।
১৮৮২ সালে ঢাকা নবাবদের দানে প্রতিষ্ঠিত হয় চাঁদপুর শহরের প্রথম মসজিদ বেগম মসজিদ। হাজীগঞ্জের লক্ষী নারায়ন জিউর আখড়া স্থাপিত হয় ১৮৭৮ খ্রিঃ। চাঁদপুর কালীবাড়ী স্থাপিত হয় ১৮৮৩ খ্রিঃ। ১৮৮৫ সালে আসাম বেঙ্গল রেলপথের চাঁদপুর শাখা নির্মিত হয়। পরে আই.জি.আর.এস.এন কোম্পানীর ষ্টিমার ঘাট স্থাপিত হয়। বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে সারা ভারতে চাঁদপুরের পরিচিতি ছিল। এটি ছিল পাট ব্যবসায়ের অন্যতম কেন্দ্র। চাঁদপুরকে এক সময় বৃটিশ ভারতের গেটওয়ে টু ইস্টার্ণ ইন্ডিয়া বলা হতো। চাঁদপুর জেলার চালিতাতলীর এডওয়ার্ড ইনষ্টিটিউট এ জেলার সর্ব প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
জি.পি ওয়াইজ মেঘনা তীরবর্তী শ্রীরামদী- ব্রাক্ষণচর, নাছিমপুর, ভড়ঙ্গারচর এবং আকানগর নামক স্থানগুলোতে কুঠি স্থাপন করে নীল চাষ শুরু করেছিলেন। ১৮৬৬ সনে এই নীল চাষের পূর্ণ উন্নতি সাধিত হয়েছিল। কিন্তু নীল চাষীদের দূর্বার প্রতিরোধের মুখে ১৮৭৩ সালে এ অঞ্চল থেকে নীল চাষ বন্ধ হয়ে যায়। বেশীর ভাগ নীল কুঠি এখন মেঘনা গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তবে ফরিদগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত সাহেবগঞ্জে এখনও কিছু নীল কুঠি আছে।
মতলব উপজেলার একটি গ্রামের নাম মতলবগঞ্জ। এটি বৈরাগী বাজার নামে পূর্বে পরিচিত ছিল। প্রায় ১৫০ বছর আগে কিছু বৈরাগী এ জায়গায় বসতি স্থাপন করে এবং তখন পাশ্ববর্তী এলাকার লোকজন এলাকায় আসতে শুরু করে। পরে এ জায়গা বাজার হিসেবে গড়ে উঠে এবং বৈরাগীবাজার নাম ধারণ করে। এভাবে জায়গাটিতে বাজার সৃষ্টি হয় এবং ধনাগোদা নদীর তীরে একটি গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর গড়ে উঠে। প্রায় ৮০/৯০ বছর আগে পাশ্ববর্তী দীঘলদি গ্রামের জনৈক মোতালেব জমাদারের নাম অনুসারে বৈরাগী বাজারকে মতলবগঞ্জ বাজার নামকরণ করা হয়। এভাবে গড়ে উঠা মতলবগঞ্জ বাজার বর্তমানে মতলব উপজেলার উপজেলা হেড কোয়াটার্স।
লক্ষ্মীপুর জেলা :
মসজিদওদরগাহসমূহঃ
তিতা খাঁ জামে মসজিদ, মিতা খাঁ মসজিদ, মজুপুর মটকা মসজিদ, মধুবানু মসজিদ, দায়েম শাহ মসজিদ, আবদুল্লাহপুর জামে মসজিদ, রায়পুরের কেরোয়া গ্রামের জ্বীনের মসজিদ, শ্যামপুর দায়রা শরীফ, কচুয়া দরগাহ, হরিশ্চর দরগাহ, কাঞ্চনপুর দরগাহ, বড় মসজিদ
উপসনালয়ঃ
শ্রীগোবিন্দ মহাপ্রভুর জিউ আখড়া, দালাল বাজার মঠ, রাম গতির রাণী ভবানী কামদা মঠ
লক্ষ্মীপুরের মৃৎশিল্প
বাংলার মৃৎশিল্প কুটির শিল্পেরই একটি অংশ। এক সময় এ শিল্পের জন্য বাংলাদেশের গর্ব ছিল। লক্ষ্মীপুর ভূ-খন্ডে জনবসতি স্থাপনের আদিপর্ব থেকে গৃহস্থালীর জন্য মাটির তৈরী জিনিসপত্রের চাহিদা শুরু হয়। ক্রমশঃ মৃৎশিল্পের কারিগরগণ আসেন এবং বসতি স্থাপন করেন। ফলে এ জেলার প্রতি উপজেলায় কুমোর বাড়ি দেখা যায়। কুমোরগণ কয়েক পুরুষ থেকে হাড়ি- পাতিল, মিটকি, কলস, বদনা, বইয়াম, মুচি বাতি, আগুনের বোশি প্রভৃতি গৃহস্থালীর অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং মেলার জন্য মাটির রঙ-বেরঙের খেলনা তৈরী করেন। বাড়ির মহিলারাও মৃৎশিল্পের শ্রমিক। তারা মাটির সামগ্রী তৈরীর পাশাপাশি বিভিন্ন ডিজাইনের রঙ করতেন। মাটির সামগ্রীর মাঝে মৃৎশিল্পীদের বিভিন্ন ডিজাইনের রঙের ছোঁয়া আমাদের মনকে পুলকিত করে তোলে।
লক্ষ্মীপুরে মৃৎশিল্পের বিবরণ
লক্ষ্মীপুরের পৌর এলাকার মজুপুর গ্রামের গোপীকৃষ্ণ পাল ১৯৭৩ সাল থেকে মাটির কাজের সাথে সম্পৃক্ত আছেন। মাটি দিয়ে তিনি পুতুল ও বিভিন্ন রকমের খেলনা যেমন- গরু, ঘোড়া, পাতিল, মোরগ, হাঁস, ব্যাংক, বাঘ, টিয়ে পাখি, চড়ুই পাখি, টুনটুনি পাখি, হাতি ইত্যাদি তৈরী করেন এবং এসব তিনি দোকানে ও মেলায় বিক্রয় করে জীবিকা নির্বাহ করেন। মজুপুরের পালকান্দির মৃত রমনী পাল ও তার ভাইগন পূর্ব পুরুষের ধারায় দীর্ঘকাল থেকে পারিবারিকভাবে মৃৎশিল্পের কাজ করেছেন। এখনও পালকান্দিতে মৃৎশিল্পের কাজ চলছে। উত্তর বাঞ্চানগর কুমোর বাড়ী, গঙ্গাপুর পালবাড়ি ও ধর্মপুর কুমোর বাড়ীতে শত শত বছর থেকে বংশপরম্পরায় মৃৎসামগ্রী তৈরী হচ্ছে। ভবানীগঞ্জের ধর্মপুরে ১০/১৫ টি বাড়ীতে মৃৎসামগ্রী তৈরী হয়। রাধাপুর গ্রামের ১টি বাড়ী ৪/৫ পরিবার, দালালবাজার খোয়াসাগর দীঘির পূর্ব পাড়ে ১টি বাড়ী ২/৩ পরিবার, মজুপুর গ্রামে ৪/৫ বাড়ী, চৌপল্লী গ্রামের ১ টি বাড়ী ৪/৫ পরিবার, হামছাদীতে ২টি বাড়ী ১০/১৫ পরিবার মৃৎ সামগ্রী তৈরী করে থাকে।
খলিফা দরজা থেকে নেমে আড়াই থেকে তিন মাইল দূরে শৈরশৈ নামক এক গ্রামে ৬ বাড়ীতে অনেক পরিবার মৃৎশিল্পের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কুমোর বাড়ীর লোকেরা প্রতিমা, খেলনা, হাড়ি-পাতিল তৈরী ও রঙ করে হাট-বাজার, মেলা ও বাড়ী বাড়ী নিয়ে বিক্রি করেন। মৃত বোবা হেলাল নন্দী ও ছেলে নারায়ন নন্দী মাটির প্রতিমা তৈরীর কারিগর হিসেবে প্রসিদ্ধ।
রায়পুর বাজারের রামকৃষ্ণ পাল, অর্চনা পাল, মোহন বাঁশী পাল, মিনা পাল, শামিত্ম পাল গৃহস্থালীর সামগ্রীর সাথে ফুল, পাখি, ফল, পশু ও মুখোশ তৈরী করে পূর্ব পুরুষদের সুনাম অক্ষুণ্ন রেখেছেন।
রামগতির করুনানগরের চন্দ্র মোহন পাল কয়েক পুরুষ পূর্ব থেকে মৃৎশিল্পের কাজ করতেন। বর্তমানে এ পরিবার উচ্চ শিক্ষিত হয়ে অন্য পেশা বেছে নিলে মাটির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে এখানে মৃৎসামগ্রী আসে, যেমন- বরিশাল, পটুয়াখালী, ঢাকার রায়ের বাজার, সাভার, টাঙ্গাইল ইত্যাদি।
প্রতিমা তৈরীর কারিগরঃ
হিন্দু সম্প্রদায় মাটি দিয়ে প্রতিমা তৈরী করে এবং অর্চনা করে। তাই প্রতিমা তৈরীতে মৃৎশিল্পের অবদান অনস্বীকার্য এবং যুগ যুগ ধরে হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে তা গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে আসছে। লক্ষ্মীপুরে দূর্গা প্রতিমার কিছু কারিগর আসে ধর্মপুর থেকে আর বাকী সব কারিগর আসে ফরিদপুর জেলা থেকে। লক্ষ্মী, স্বরস্বতী প্রতিমা তৈরীর কারিগর আসে ধর্মপুর, হামছাদী ও রামগঞ্জ থেকে।
ব্যবহৃত মাটির উৎসঃ
এ মাটির কিছু অংশ আসে রামগঞ্জ থেকে। বাকী সব মাটি নোয়াখালী জেলার জমিদার হাট সংলগ্ন পপুলার বিস্কুট ফ্যাক্টরীর সামনের জমি থেকে কিনে আনা হয়। কারণ এ অঞ্চলে এ মাটি পাওয়া যায় না, এর জন্য প্রয়োজন আঠালো মাটি যা কুমারিরা মাটি নামে পরিচিত। এখানকার মাটি সাধারণত বেলে মাটি।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস